আন্তর্জাতিক ডেস্ক : একটা সময় মরণ নেশা মদ্যপান ও জুয়ার করাল গ্রাসে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল পুরো গ্রাম। কিন্তু দাবা খেলার মাধ্যমে সেই গ্রামটি এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এখন পরিচিতি লাভ করেছে ‘দাবার গ্রাম’ হিসেবে।
সম্প্রতি এই অভাবনীয় ঘটনাটি ঘটেছে দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের ছোট্ট গ্রাম মারোত্তিচালে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, কেরালার থ্রিসুর জেলায় অবস্থিত প্রায় ৬,০০০ জনসংখ্যার ছোট্ট গ্রাম মারোত্তিচাল। এই গ্রামেরই একটি চায়ের দোকানে প্রতিদিনই বসে দাবার প্রতিযোগিতা। এখানেই চোখ বন্ধ করে খেলেও প্রতিপক্ষকে নিমিষে হারিয়ে দেয় গৌরিশংকর জয়ারাজ নামের ১৫ বছর বয়সি এক কিশোর।
গ্রামের বাসিন্দা বেবি জন বলেন, ‘গৌরিশংকর মাত্র ১৫ বছর বয়সেই এক প্রতিভাবান দাবাড়ু। চোখ বন্ধ করেও আমাকে হারিয়ে দেয়!’
গ্রামের ৭৫ শতাংশের বেশি মানুষ এখন দাবা খেলতে পারে। রাস্তার পাশে, দোকানের সামনে, এমনকি বাসস্ট্যান্ডেও দাবার বোর্ডে মনোনিবেশ করে থাকেন সবাই।
মদ ও জুয়ার কবল থেকে মুক্তির সংগ্রাম
অথচ ৭০-এর দশকে মারোত্তিচালের কয়েকটি পরিবার নিজেরাই বাড়িতে মদ তৈরি করত। আর আশির দশকের দিকে গ্রামটি অবৈধ মদ ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। রাতভর চোলাই মদের আসর বসত, আর মদের সঙ্গি ছিল জুয়া।
গ্রামের কৃষক ও সাধারণ মানুষ দিনে কাজ করলেও রাতে এই মদ ও জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ত। এভাবে ধীরে ধীরে দারিদ্র্য গ্রাস করতে থাকে পুরো গ্রামকে।
গ্রামবাসীদের একজন বলেন, তখনকার দিনে কেউ ঠিকমতো খাওয়ার টাকা জোগাড় করতে পারত না, অথচ মদের আসরে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা উড়ত!
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, অনেক পরিবার চরম অভাব-অনটনের মুখে পড়ে। শিশুদের জন্য খাবার কেনার সামর্থ্য পর্যন্ত ছিল না। অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষা নিতে পারেনি।
পরিবর্তনের নায়ক: চারালিয়িল উন্নিকৃষ্ণন
এই সংকটময় সময়ে গ্রামে ফিরে আসেন চারালিয়িল উন্নিকৃষ্ণন। তিনি একটা সময় ভারতের মাওবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তবে পরে সেখান থেকে সরে এসে নিজের গ্রামে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি নিজ গ্রামে ফিরে প্রথমে একটি চায়ের দোকান খোলেন। কিন্তু শীঘ্রই বুঝতে পারেন যে, তার গ্রাম ধ্বংসের পথে। তখন তিনি একটি বিপ্লবী সিদ্ধান্ত নেন—গ্রামকে মদমুক্ত করার!
তিনি গ্রামের কয়েকজন তরুণকে নিয়ে শুরু করেন গোপন অভিযান। মদের আস্তানাগুলোর সন্ধান পেলে তারা রাতের অন্ধকারে সেখানে হানা দিতেন। তারা মদের বোতল ও চোলাই মদ ধ্বংস করতেন। মদ তৈরি ও বিক্রির সরঞ্জাম ধ্বংস করতেন। মদ্যপান ও জুয়ার বিরুদ্ধে প্রচার চালাতেন।
একই সঙ্গে গ্রামের নারীদেরও সংগঠিত করতেন। যারা নিজেদের স্বামী-সন্তানদের এই অভ্যাস থেকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন।
এর ফলে ধীরে ধীরে মদ ও জুয়ার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। তবে শুধু নিষিদ্ধ করলেই যে সমস্যার সমাধান হয় না—তাদেরকে বিকল্প কিছু দিতে হয়।
দাবার প্রবেশ ও বিস্তার
উন্নিকৃষ্ণন বুঝতে পারেন যে, গ্রামের মানুষকে কিছু অর্থবহ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিনোদন দিতে হবে। যাতে তারা মদের দিকে আর ফিরে না যায়। তখনই তিনি গ্রামে দাবা খেলা শেখানো শুরু করেন।
প্রথমে কয়েকজন শিখলেও, ধীরে ধীরে পুরো গ্রাম দাবার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
এর ফলে তরুণরা রাতে মদ খাওয়ার বদলে দাবার আসরে বসতে শুরু করল। পরিবারগুলো একসঙ্গে দাবা খেলে সময় কাটাতে লাগল। গ্রামে দাবার টুর্নামেন্টও শুরু হয়, যা পরে কেরালাজুড়ে জনপ্রিয়তা পায়।
গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, আগে মানুষ বোতলের চারপাশে জড়ো হতো। আর এখন দাবার বোর্ডের চারপাশে জড়ো হয়।
১. দাবা এখন প্রতি ঘরে: মারোত্তিচালের গ্রামের ৭৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ এখন দাবা খেলতে জানে। তারা শুধু মজা করার জন্যই খেলে না, বরং কৌশলগত চিন্তাভাবনা ও বুদ্ধির বিকাশের জন্য খেলে।
২. বিদ্যালয়ে দাবা পাঠ্যসূচির অংশ: উন্নিকৃষ্ণনের প্রচেষ্টায় গ্রামটির প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে দাবাকে পাঠ্যসূচির অংশ করা হয়েছে।
৩. বড় বড় দাবাড়ুর জন্ম হচ্ছে: গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখন কেরালা, এমনকি ভারতের বিভিন্ন বড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে।
জয়েম ভাল্লুরের গল্প
এদিকে জয়েম ভাল্লুর নামে গ্রামের আরেক বাসিন্দা তার জীবনের একটা পর্যায়ে মারাত্মক এক দুর্ঘটনার শিকার হন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তিনি কোমায় চলে যান এবং শরীরের বেশিরভাগ অংশ পঙ্গু হয়ে যায়।
কিন্তু হাসপাতালে থাকা অবস্থায় তার বন্ধুরা তাকে নিয়মিত দাবা খেলার জন্য উত্সাহিত করেন। ধীরে ধীরে তার মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ফিরে আসে। এর ফলে এখন কেবল তার ডান হাতটাই পঙ্গু রয়ে গেছে, শরীরের বাকি অংশটা পুরোপুরি সুস্থ।
তার ভাষায়, ‘দাবাই আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে’!
ফ্রান্সিস কাচাপিলি নামের আরেক যুবক, যিনি এখন দাবার মাধ্যমে নতুন জীবন পেয়েছেন। তার ভাষায়, ‘আমরা আগে হতাশ ছিলাম, দিশাহীন ছিলাম। দাবা আমাদের নতুন পথ দেখিয়েছে।’
মদ-জুয়ার আঁতুড়ঘর সেই মারোত্তিচাল আজ গোটা ভারতের মধ্যে দাবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এখানেই শেষ নয়, এই গ্রামটি ২০১৬ সালে এশিয়ান রেকর্ডও অর্জন করে, একসঙ্গে ১,০০১ জন শখের দাবাড়ুর একযোগে খেলার জন্য।
গৌরিশংকর জয়ারাজ: ভারতের নতুন দাবার তারকা
এই গ্রামেরই ছেলে গৌরিশংকর জয়ারাজ এখন ভারতের শীর্ষ ৬০০ দাবাড়ুর মধ্যে অন্যতম। তার লক্ষ্য এখন গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া।
গৌরিশংকরের মা একসময় দাবা শিখেছিলেন গ্রামেরই অভিজ্ঞদের কাছ থেকে। এখন তার ছেলে দেশের হয়ে বিশ্ব দাবার মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন দেখছে।
মারোত্তিচাল গ্রামের মানুষের আশা, ‘দাবার কারণেই আজ বিশ্ব আমাদের চিনেছে। আর গৌরিশংকর আমাদের গর্বিত করেছে। এই গৌরিশংকরই একদিন পুরো ভারতকে গর্বিত করবে’।
(আল-জাজিরার প্রতিবেদন থেকে অনূদিত)।