নিউজ ডেস্ক : আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) অন্যতম শর্ত ছিল খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। কিন্তু খেলাপি ঋণ তো কমেইনি, উলটো লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। আগামী বছরও খেলাপি ঋণ কমার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে আসছে আইএমএফ মিশন। এবার সংস্থাটির মূল প্রশ্নই হবে-খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কীভাবে ঠেকাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে কী কৌশল নেবে। হঠাৎ খেলাপি ঋণ এত বাড়ল কেন? একই সঙ্গে প্রশ্ন আসবে-আগের সরকারের তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও। সব মিলে এবার খেলাপি ঋণ নিয়েই বড় প্রশ্নের মুখে পড়বে সরকার।
সূত্র জানায়, আইএমএফ-এর সম্ভাব্য প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এবার আইএমএফ-এর সামনে গত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতের লুটপাটের চিত্র তুলে ধরা হবে। একই সঙ্গে পাচার হওয়া অর্থের চিত্রও উপস্থাপন করা হবে। এসব ঋণ আদায় হওয়ার মতো অবস্থায় নেই বলে এগুলো খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। যে কারণে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। লুটপাটের পাচার হওয়া ঋণের আরও কিস্তি আগামী দিনে মেয়াদোত্তীর্ণ হবে। তখন ওইসব ঋণও খেলাপি করা হবে। এসব কারণে আগামী বছরও খেলাপি ঋণ বাড়বে। একই সঙ্গে গত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণসহ নানা উপকরণের প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত গোপন করে জালিয়াতি আড়াল করার চিত্রও তুলে ধরা হবে। আইএমএফ-এর ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ ডিসেম্বরে ছাড় হওয়ার কথা রয়েছে। ঋণের তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে দেওয়া যেসব শর্ত চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে, সেগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে মিশনটি। এ লক্ষ্যে ৪ ডিসেম্বর আইএমএফ-এর একটি মিশন ঢাকায় আসছে। একই সঙ্গে মিশনটি সরকারের চাওয়া বাড়তি অর্থ দেওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করবে।
আইএমএফ-এর অন্যতম একটি শর্ত ছিল আগামী মার্চের মধ্যে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি সার্কুলার জারির মাধ্যমে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের করেছে। নতুন এ সংজ্ঞা কার্যকর হবে আগামী বছরের এপ্রিল থেকে। এতে সব ধরনের ঋণ বা ঋণের কিস্তি পরিশোধের নির্ধারিত দিনের তিন মাস পর থেকেই খেলাপি হিসাবে গণ্য করার বিধান করা হয়েছে। বর্তমানে মেয়াদি ও কৃষিঋণ ছয় মাস পর খেলাপি হচ্ছে। এসব ঋণের ক্ষেত্রে খেলাপি করার মেয়াদ তিন মাস কমানো হয়েছে। এর প্রভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।
আইএমএফ-এর ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত রয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। সরকারি বিশেষায়িত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ গত ডিসেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা সামান্য কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার শর্ত রয়েছে। গত ডিসেম্বরে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশে।
দেশের ব্যাংক খাতে ১৫ বছরে যেসব জালিয়াতি হয়েছে, সেগুলোর বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ওইসব ঋণ এতদিন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা খেলাপি হওয়ার যোগ্য হলেও খেলাপি হিসাবে চিহ্নি করেননি। সেগুলোকে তারা বেআইনিভাবে নিয়মিত দেখিয়েছেন। এর মাধ্যমে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হয়েছে। যে কারণে সরকার পরিবর্তনের পর নতুন সরকারের আমলে দুটি ত্রৈমাসিকের খেলাপি ঋণের চিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, জুন প্রান্তিক ও সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। ফলে এখন খেলাপি ঋণ বেড়ে ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংক খতের সব জালিয়াতির তথ্য এখনো প্রকাশিত হয়নি। এস আলম গ্রুপের দখল করা নয়টি ব্যাংকের পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ পুনর্গঠন করে দেওয়া হয়েছে। ওইসব ব্যাংকে এখন অডিট হচ্ছে। এতে জালিয়াতির সব তথ্য বের হতে আরও সময় লাগবে। ওইসব তথ্য বের হলে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে ফেব্রুয়ারিতে খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এতে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সরকার পতনের আগেও এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে যেমন সংশয় ছিল, তেমনই ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই লক্ষ্য অর্জন যে একেবারেই সম্ভব হবে না, তা নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, এখন বহুবিদ কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করবে বাংলাদেশ।
এছাড়াও আইএমএফ-এর শর্ত ছিল খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে এবং ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্দ করে সেগুলো থেকে ঋণ আদায় করতে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করার। এ বিষয়ে সরকার থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একটি নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। তবে দেশে ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে বন্ধকি সম্পদ জব্দ করে সেগুলোর ব্যবস্থাপনার জন্য অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নেই। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বেসরকারি খাতের কয়েকটি এজেন্সি থাকলেও তাদের কার্যক্রম এখনো সন্তোষজনক ও গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। যে কারণে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। এ ধরনের কোম্পানি গঠনের বিষয়ে ভারত ও সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সুপারিশ করেছেন ব্যাংকাররা। ওইসব দেশসহ থাইল্যান্ড, চীন, নেপাল বেশ সফল হয়েছে।