নিউজ ডেস্ক : মা সূর্যবান বিবি পথ চেয়ে বসেছিলেন। বুকের মানিক ইলিয়াস আলী ফিরে আসবে আবার বুকে। প্রিয়তমা স্ত্রী তাহমিনা রুশদীর লুনা’র অপেক্ষাও শেষ হচ্ছিল না। বিশ্বাস ছিল, সব শঙ্কা ভুল প্রমাণ করে স্বামী একদিন ফিরবেন তার ঘরে। তিন সন্তানও অপেক্ষায় দিন গুনছিল। তাদের আদরের বাবা ফিরে এসে আবার বুকে জড়িয়ে নেবেন। দলের নেতাকর্মীরা তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে ছিলেন, এই বুঝি তারা শুনবেন, প্রিয় নেতা ফিরে এসেছেন। মুক্তি পেয়েছেন গুমঘর থেকে। আয়নাঘর থেকে বেরিয়ে আবার এসে দাঁড়িয়েছেন জনতার সামনে, রাজনীতির মঞ্চে।
কিন্তু কারও মনের আশা আর পূরণ হলো না। গত বুধবার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সেই দুঃসংবাদ। যার জন্য কেউই অপেক্ষায় ছিলেন না। বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেটের মানুষ। তাজুল ইসলাম আটক হওয়া আয়নাঘর হিসেবে পরিচিত গুমঘরের প্রধান হোতা আটক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানের বরাতে জানালেন, জিয়াউলের নেতৃত্বে এম ইলিয়াস আলীকে গুমের পর হত্যা করা হয়েছে। এ কথা জিয়াউল আহসান জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। যা তিনি আদালতকেও জানিয়েছেন।
এ তথ্য জানার পর এতদিন সবার মনে যে আশা ও সম্ভাবনার বাতি নিভু নিভু করে জ্বলছিল, তাও নিভে গেছে। এবার পানির মতো স্পষ্ট হয়ে গেল শেষমেশ কী ঘটেছে গুম হওয়া এম ইলিয়াস আলীর ভাগ্যে। পতিত সরকারের অন্ধকার গুমঘরে থেকে একটি সাহসী রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়ে গেছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে। এরই মাধ্যমে পরিবার ও দলের অপেক্ষার দিন শেষ হয়ে গেল। খবর নিশ্চিত হওয়ার পর সিলেটে এ নিয়ে চলছে তোলপাড়। নেতাকর্মী ও ইলিয়াসভক্তদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে। ইলিয়াস আলী ছিলেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি। ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য এবং সিলেট অঞ্চলের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় নেতা।
গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গুমঘর থেকে একে একে বেরিয়ে আসছিলেন বন্দি হওয়া রাজনৈতিক নেতারা। সবাই বের হলেও অনেকে ছিলেন অজানায়। ছিলেন না তারা গুমঘরেও। কী ঘটেছে তাদের ভাগ্যে এই প্রশ্ন যখন সর্বত্র তখন আশায় বুক বেঁধে বসেছিলেন গুম নেতা ও অন্যদের পরিবারের সদস্যরা। এরই মধ্যে অনেকের ব্যাপারে জানাও গিয়েছিল, কী পরিণতি হয়েছে তাদের ভাগ্যে। কিন্তু জানা যাচ্ছিল না এম ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে।
অবসর নেওয়া পুলিশ কর্মকর্তা দাবিদার একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে এসে জানান, এম ইলিয়াস আলীকে গুমের কয়েকদিনের মাথায়ই হত্যা করা হয়েছে। সাগরে নিয়ে খাবার বানানো হয়েছে মাছের। কাজটা করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবং জিয়াউল আহসানের মাধ্যমেই। কিন্তু নির্ভরযোগ্য সোর্স না হওয়ায় কেউই সে কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তখন আবার আলোচনায় উঠে আসে এম ইলিয়াস আলীর গুম থেকে বের হয়ে আসার বিষয়টি। সিলেট ও তার নির্বাচনি এলাকার বিএনপির নেতাকর্মীরা আবার সরব হন তাকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে। তারা মিছিল-মিটিংও করেন। এ সময় ইলিয়াসপত্নী তাহমিনা রুশদীর লুনার একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস ওই ইস্যুর আলোচনা এবং ইলিয়াস আলী ফেরত আসার প্রত্যাশা সাধারণ মানুুষ ও নেতাকর্মীদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়।
গত ২০ আগস্ট রাতে লুনা তার ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দেন- ‘… প্রিয় ইলিয়াস আলীর জন্য দোয়া করবেন। …আমরা শুধু পরিবারের পক্ষ থেকে বলছি তার (ইলিয়াস আলী) জন্য দোয়া করতে। আমাদের এখনো দৃঢ় বিশ্বাস- তিনি বেঁচে আছেন। প্রথম থেকেই আমরা এ আশা পোষণ করে আসছি। তাই সব সময় তাঁর সুস্থতার জন্য বিভিন্ন স্থানে দোয়া করিয়েছি বা করাচ্ছি।’
এর আগে ২০ আগস্ট মাগরিবের নামাজের পর সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার গহরপুর জামেয়া মসজিদে ইলিয়াস আলীর পারিবারিক উদ্যোগে তার সুস্থতা কামনায় খতমে বুখারি ও দোয়া মাহফিল করা হয়। এতে বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলা বিএনপি এবং তার অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নিখোঁজ এম ইলিয়াস আলীকে নিয়ে ফের তোলপাড় শুরু হয়। গুঞ্জন উঠে তার বেঁচে থাকার। কিন্তু তিনি জীবিত না মৃত এ বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে কখনোই কোনো পরিষ্কার বক্তব্য আসেনি। অনেকেই মনে করেন, পরিবারের সদস্যরা ‘ইলিয়াস আলীকে গুমের পর হত্যা করা হয়েছে’ এ কথা জানলেও তারা ‘ইলিয়াস আলী ইস্যু স্পষ্ট হয়ে গেলে রাজনৈতিক মাঠে সাধারণ মানুষের সিম্পিথির খরায় পড়বেন’ এ জন্য তা প্রকাশ বা স্পষ্ট করেননি।
বরং ‘ইলিয়াস আবেগকে বাঁচিয়ে রাখতে বালাগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালামের বরাতে দোয়া মাহফিলের পর কয়েকটি গণমাধ্যম জানায়, যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত এম ইলিয়াস আলীর ছোট ভাই মো. আছকির আলী জানিয়েছেন, ইলিয়াস আলী বিদেশের একটি হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন। তবে কোন দেশের হাসপাতালে সেটি জানাননি। এরপরই সিলেটে বিএনপি ও সাধারণ মানুষ তাকে গুম হওয়া থেকে মুক্তি দেওয়ার দাবিতে সভা-মিছিল করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা হয়।
ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানী ঢাকা থেকে গাড়িচালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন। তারপর একযুগ ধরে নিখোঁজ রয়েছেন তিনি। ধারণা করা হয়েছিল, পতিত সরকার প্রতিহিংসার কারণে তাকে গুমঘরে বন্দি করে রেখেছে। তার গুম হওয়ার পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা- ‘র’-এর সম্পৃক্ততারও অভিযোগ তুলেন কেউ কেউ। তাদের দাবি, টিপাইমুখ নিয়ে অতিরিক্ত ‘বাড়াবাড়ি’ বা সোচ্চার হওয়ার পরিণতিতে ‘র’ তাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। সে সময় রাজনৈতিক মহলে আলোচনা ছিল, মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের শাসন আমল ওয়ান-ইলেভেনের সময় র’ই ইলিয়াস আলীকে ‘নিরাপদ’ রেখেছিল। এ সময় বাঘা বাঘা নেতারা ধরপাকড়ের শিকার হলেও ইলিয়াস আলী ছিলেন নিরাপদে। কিন্তু র’র ওই ‘নিরাপত্তা’ দেওয়ার বিষয়টি একসময় ভুলে যান ইলিয়াস আলী। তিনি টিপাইমুখ ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন। রাজনৈতিক মহল এটিও তার গুম হওয়ার কারণ হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করতেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নিখোঁজের পর দীর্ঘ ১২ বছর ইলিয়াস আলীর পরিবার ও বিএনপি তার ফেরার ব্যাপারে আশাবাদ দেখালেও তারা জানতেন, ইলিয়াস আলীকে গুমের পরপরই হাসিনা সরকার তাকে হত্যা করেছে।
ইস্যুটি রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে ইলিয়াস আলী বেঁচে থাকার আশা মানুষের মনে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। কেননা সিলেটের মানুষ ইলিয়াস আলী নিয়ে অনেক আবেগী।
দলমতের ঊর্ধ্বে প্রায় প্রত্যেকেই তাকে পছন্দ করতেন। যে জন্য নিখোঁজের পর তাকে ফেরত পাওয়ার জন্য কয়েকদিনের আন্দোলনে তার নির্বাচনি এলাকার অন্তত ৫ জন প্রাণ দিয়েছিলেন।
অচল করে ফেলেছিলেন পুরো সিলেটকে। ঢাকার একটি সূত্র এ প্রতিবেদককে সে সময় জানিয়েছিল, গুমের ৩ থেকে ৪ দিনের মাথায় তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু কোনো সোর্স থেকে এটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ইলিয়াস আলীর বাবা ইন্তেকাল করলেও মা সূর্যবান বিবি এখনো বেঁচে আছেন। তার বয়স এখন ৯৪ বছর। অসুস্থ সূর্যবান এখনো ছেলের প্রতীক্ষায় থাকেন। ইলিয়াস আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ডেপুটি রেজিস্ট্রার তাহসিনা রুশদীর লুনাকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে দুই পুত্র। বড় ছেলে ব্যারিস্টার মো. আবরার ইলিয়াস এবং ছোট ছেলে মো. লাবিব শারর ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। একমাত্র কন্যা সাইয়ারা নাওয়াল।