স্পোর্টস ডেস্ক : বিদায়ী ২০২৪ সাল বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সাফল্যের চূড়া যেমন দেখিয়েছে, তেমনি দেখিয়েছে পতনের অতল গহ্বরও। পাকিস্তানে গিয়ে টেস্ট সিরিজ জয়ের কৃতিত্বের পাশাপাশি আছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারের লজ্জাও। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বিদায় নিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির আসনে থাকা নাজমুল হাসান পাপন। তারই ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা চ-িকা হাথুরুসিংহেকেও বিসিবি বিদায় করেছে। বাতিল হয়েছে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের দরপত্রও। ২০২৪ সাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর, ক্রিকেটেও তাই। রাজনীতির সঙ্গে ক্রিকেটের যে ওতপ্রোত সম্পর্ক, তার প্রভাব পড়েছে মাঠে এবং মাঠের বাইরেও। তবে সব ছাপিয়ে ২০২৪ আসলে সাকিব আল হাসানের বিদায়ের বছর।
২০২৪ সালে তিন সংস্করণ মিলিয়ে বাংলাদেশ খেলেছে ৪৩টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ। ১০ টেস্ট, ৯ ওয়ানডে ও ২৪ টি-টোয়েন্টি। এর ভেতর সফলতম সংস্করণ বলা যায় টেস্টকে, কারণ ১০ ম্যাচের ৩টি জিতেছে বাংলাদেশ। ৩টিই দেশের বাইরে। রাওয়ালপিন্ডিতে পরপর দুই টেস্টে পাকিস্তানকে হারিয়ে প্রথমবার পাকিস্তানকে তাদের মাটিতেই হোয়াইটওয়াশ করার কৃতিত্ব দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বছরের শেষভাগে জ্যামাইকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ, যার ফলে প্রথমবারের মতো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের কোনো চক্রে পয়েন্ট টেবিলের একেবারে তলানিতে থাকছে না লাল-সবুজ পতাকাটা। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ খেলেছে ৩ ম্যাচের ৩টি সিরিজ; প্রতিপক্ষ যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৯ ম্যাচের ৩টিতে মাত্র জয়, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২-১ সিরিজ জিতলেও বাকি দুটো সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হার ওয়ানডে নিয়ে বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাসে দিয়েছে জোরালো ধাক্কা।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার এইটে খেলার কৃতিত্ব ম্লান হয়ে গেছে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালের সমীকরণ মেলানোর ম্যাচে কাপুরুষোচিত আচরণে। এই সংস্করণেই সবচেয়ে খারাপ করেছে বাংলাদেশ। ২৪ ম্যাচে ১২ জয়, ১২ হার; সাফল্যের হার ৫০ ভাগ হলেও হাথুরুসিংহে জমানায় টি-টোয়েন্টির সঙ্গে বেমানান নেতিবাচক কৌশলের জন্য সমালোচিত হয়েছেন ক্রিকেটাররা। বিশ্বকাপের আগে টেক্সাসে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ২-১ ব্যবধানে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হার, দেশে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও প্রস্তর যুগের ক্রিকেটের প্রদর্শনীসহ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নেতিবাচক ক্রিকেট খেলায় প্রশ্ন ওঠে খেলোয়াড়দের সামর্থ্য নিয়ে। অবশ্য বছরের শেষদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টি-টোয়েন্টিতে ৩ ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ, তাতে করে নতুন কোচ ফিল সিমন্সকে ঘিরে বেড়েছে প্রত্যাশার ডালপালা।
বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা সাকিব আল হাসানের অবসর এবং অলিখিত নির্বাসন ও অবশেষে বোলিংয়ে নিষিদ্ধ হওয়া। আওয়ামী লিগের সাবেক সাংসদ সাকিব জুলাই আন্দোলনের গণহত্যার সময় ছিলেন নির্বিকার। সময় কাটিয়েছেন প্রমোদ ভ্রমণে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিলে অবসান হয় সাকিবের মাস ছয়েকের সাংসদ জীবনের। কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে সাংসদ হয়ে আসা সাকিবের বিপক্ষে হত্যা মামলা হয় এরপর, তার ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা। আসতে থাকে কাঁকড়ার খামার, শেয়ারবাজারসহ নানান জায়গায় সাকিবের দুর্নীতির খবর। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় বিদেশে থাকা সাকিব আর দেশে ফিরতে পারেননি। বারবার বিসিবির কাছে দেশে ফিরে আবার বিদেশে যাওয়ার নিশ্চয়তা চাইলেও সাকিবকে বিসিবি সাফ জানিয়ে দেয় আইনি এবং রাজনৈতিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তাদের নেই।
ভারতের বিপক্ষে কানপুর টেস্টের আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ দিয়ে টেস্ট সিরিজের ইতি টানার ঘোষণা দেন সাকিব, একই সঙ্গে জানিয়ে দেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে শেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি অধ্যায়েরও। তবে কানপুরের পর দেশে এসে খেলতে পারেননি সাকিব, তার বিরোধীদের রাজপথ দখল ও হুমকির মুখে কড়া পাহারায় মিরপুরে টেস্ট ম্যাচ মাঠে গড়ালেও সাকিব আর খেলতে পারেননি। দেশের পথে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রওনা হলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তাকে ফিরে যেতে হয়। বছরের শেষে আরেক দুঃসংবাদ পান সাকিব। ইংলিশ কাউন্টিতে খেলতে গিয়েছিলেন সাকিব, চেন্নাই টেস্টের আগে। সেখানে তার বোলিং অ্যাকশন সন্দেহজনক হিসেবে প্রতিবেদন দেন আম্পায়াররা। ল্যাব পরীক্ষায় দেখা যায় সাকিব অনুমোদিত ১৫ ডিগ্রির চেয়ে বেশি হাত বাঁকাচ্ছেন। এরপর ১৫ ডিসেম্বর সাকিবের বোলিং অবৈধ ঘোষণা করে ইসিবি, যা মেনে নেয় আইসিসিও। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এবং আইসিসি অনুমোদিত সব ধরনের ঘরোয়া ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় বল করতে পারবেন না সাকিব, তাকে উৎরে আসতে হবে শুদ্ধি পরীক্ষায়।
এই বছর টি-টোয়েন্টিকে বিদায় বলেছেন মাহমুদউল্লাহও। ভারত সফরে হায়দ্রাবাদে খেলেছেন শেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি, কিন্তু তার বিদায়ী ম্যাচে ভারত যে বেধড়ক পিটুনি দিয়ে টি-টোয়েন্টিতে ২৯৭ রান করে, তাতে আসলে মাহমুদউল্লাহ ম্যাচটা ভুলতেই চাইবেন।
সাকিব ও মাহমুদউল্লাহর অস্তাচলের বছর উজ্জ্বল জাকের আলী অনিক, হাসান মাহমুদ ও নাহিদ রানা। জাকেরের ব্যাটিং হাসান ও নাহিদের পেস বোলিং আভাস দিচ্ছে, আগামীতে অভিজ্ঞদের ছাড়াই ভালো করার সামর্থ্য আছে বাংলাদেশের।
মাঠের বাইরে বড় পরিবর্তন বিসিবি সভাপতি পদে বদল। সাবেক ক্রীড়ামন্ত্রী পাপন পালিয়ে গেছেন, বিসিবিতে তার সহচর অনেকেই আত্মগোপনে। ১১ জন পরিচালক পদ হারিয়েছেন, ৩ জন পদত্যাগ করেছেন। নতুন সভাপতি হয়েছেন সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ। বিসিবি পরিচালক হয়েছেন ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম। তাদের তত্ত্বাবধানেই নতুন চেহারা পেয়েছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ। উধাও হয়ে গেছে আগের কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজি, এসেছে কিছু নতুন নাম।
ঘরোয়া ক্রিকেটে নতুন করে চালু হয়েছে টি-টোয়েন্টির জাতীয় লিগ এনসিএল টি-টোয়েন্টি। নারী ক্রিকেটে চালু হয়েছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, যা টেস্ট মর্যাদার সোপান। অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল জিতেছে যুব এশিয়া কাপ। ঘটনাবহুল ২০২৪-এ মাঠের খেলায় বড় সাফল্য একটাই। পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ। তবে মাঠের বাইরে ঘটেছে অনেক বেশি কিছু। হাথুরুসিংহের পরিবর্তে কোচ হয়েছেন ফিল সিমন্স, জাতীয় দলে ফের সুযোগ দেওয়া হয়েছে কোচ মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনকে। আর বিপিএলে প্রায় এক দশক পর ফিরেছে চিটাগং কিংস। তবে সব ছাপিয়ে বছরটা আসলে সাকিবের সর্বনাশা সমাপ্তির।