ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে পুলিশের বিরুদ্ধে বিএনপির এক নেতাকে পরিকল্পিতভাবে ইয়াবা দিয়ে আটকের পর সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ও স্বাক্ষর করা নয়টি চেক নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টাকা, চেক উদ্ধারের আবেদনসহ পুলিশের তিন সদস্যদের বিরুদ্ধে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী।
অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা হলেন আশুগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জসিম উদ্দিন, উপপরিদর্শক (এসআই) প্রদ্যুৎ ঘোষ চৌধুরী ও দীপক কুমার পাল। ভুক্তভোগী ব্যক্তির নাম নোমান মিয়া। তিনি উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য ও ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। তিনি দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা ও আশুগঞ্জ বাজারের সার পরিবহন ব্যবসায়ী।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইকবাল হোসেন, এসআই দীপক কুমার পাল ও প্রদ্যুৎ ঘোষ চৌধুরীকে থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে তাঁদের ঠিক কী কারণে প্রত্যাহার করা হয়েছে, তা জানতে চাইলে স্পষ্ট কারণ জানাননি পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাবেদুর রহমান। পুলিশ সুপার বলেন, তাঁদের প্রশাসনিক কারণে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত হচ্ছে।
এর আগে গত বুধবার রাতে নোমানকে আশুগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় করা মামলায় আটক করে পুলিশ। গত ২০ আগস্ট থানায় হওয়া ওই মামলার ৬ নম্বর আসামি ছিলেন তিনি। কিন্তু বাদী ভুলক্রমে মামলায় ওই ব্যক্তিকে আসামি করেছেন বলে আদালতে হলফনামা দিলে এবং উপজেলা বিএনপিসহ স্থানীয় লোকজনের চাপের মুখে গতকাল দুপুরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নোমান মিয়া তাঁর বাসা থেকে নেওয়া ৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা এবং স্বাক্ষরযুক্ত ৯টি খালি চেক উদ্ধারসহ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
পুলিশ সুপারের কাছে দেওয়া নোমান লিখিত অভিযোগে বলেন, ১৯ সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসির মুন্সীকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর পর থেকে নোমানকে ঘায়েল করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন নাসির। বিভিন্ন মামলায় আসামি করার জন্য আশুগঞ্জ থানা-পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ করেন নাসির। গত বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে আশুগঞ্জ বাজারে নোমানের ভাড়া বাসায় গিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তল্লাশি চালান। অপরাধমূলক কিছু না পেয়ে তাঁরা চলে যান। এর কিছুক্ষণ পর আশুগঞ্জ থানার পুলিশ যায় ওই বাসায়।
এ সময় এসআই প্রদ্যুৎ ঘোষ চৌধুরী হাতকড়া দিয়ে নোমানের কপালে এবং ঘাড়ের ডান পাশে কয়েকটি কিল–ঘুষি মারেন। নাছিরকে বহিষ্কার করিয়েছেন বলে তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেন এসআই প্রদ্যুত। পরে ওই এসআই নিজের পকেটে পলিথিনে মোড়ানো ইয়াবা নোমানের বাসার সোফার পেছনে ফেলে দেন। চিৎকার শুরু করলে পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জসিম উদ্দিন কোমর থেকে পিস্তল বের করে মাথায় ধরে তাঁকে চুপ করতে বলেন। এসআই প্রদ্যুৎ তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে সোফায় বসিয়ে রাখেন। তখন পুলিশের আরেক সদস্য এসআই দীপক কুমার পাল প্যান্টের পকেট থেকে পলিথিনে মোড়ানো ইয়াবা বাসার অন্য কক্ষে গিয়ে ফেলেন। পুলিশের ওই সদস্যরা তাঁদের সাজানো ঘটনামতো পূর্বপরিকল্পিতভাবে ফেলে দেওয়া ইয়াবা উদ্ধারের কথা বলে তাঁর বিরুদ্ধে মাদকের মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের মামলা দেবেন বলে হুমকি দেন। এরপর ওই তিন পুলিশ সদস্য ঘরের আলমারিতে ব্যাগে থাকা নোমানের ব্যবসার ৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন। পাশাপাশি ৭টি ব্যাংকের চেকবই থেকে নোমান ও তাঁর ভাইয়ের স্বাক্ষরিত ৯টি চেক নিয়ে যান পুলিশের ওই সদস্যরা।
এরপর হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তুলে নোমানকে আশুগঞ্জ থানায় নেওয়া হয়। থানায় তাঁকে সারা রাত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এসব বিষয় কাউকে বললে তাঁকে আশুগঞ্জ থানার বিভিন্ন মামলাসহ ঢাকায় বিভিন্ন থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।
আশুগঞ্জে বাদীর অনাপত্তিতে আসামিকে ছেড়ে দিল পুলিশ, ওসিসহ তিনজন প্রত্যাহার
নোমান মিয়া তাঁর বাসা থেকে নেওয়া ৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা এবং তাঁর ও তাঁর ভাইয়ের স্বাক্ষর, মোহরযুক্ত ৯টি খালি চেক উদ্ধারসহ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন জানান।
নোমান মিয়া বলেন, ‘টাকা ও চেক এখনো উদ্ধার হয়নি। তারা (পুলিশ) বাসা থেকে ১৪ ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে গিয়েছিল। জানার পর ওই স্বর্ণ উদ্ধার করে স্ত্রীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। দল থেকে বহিষ্কার হওয়া বিএনপির নেতা নাসির এসব করিয়েছেন। এ ঘটনায় থানার ওসির বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আর আমার ভাই ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ায় বিভিন্ন কাজের জন্য আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে যাওয়া-আসা ছিল। ভুয়া স্বাক্ষরে অনুমোদিত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একটি কমিটি করে প্রচার করছে একটি পক্ষ, যা সত্য নয়।’
এদিকে মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া প্রত্যাহার হওয়া ওসি ইকবাল হোসেন ও এসআই প্রদ্যুত ঘোষ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বুধবার রাতে যোগদান করেছি। ওই ব্যক্তিকে আমি চিনি না। থানার ওসি স্যারের নির্দেশে সেখানে যাই। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। আমার কাছে কোনো পিস্তল ছিল না। আমি হতভম্ব, কেন অভিযোগে আমার নাম দিয়েছে।’