অনলাইন ডেস্ক – কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি নিজ দল লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব থেকেও সরে যাচ্ছেন।
এর মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ এক অধ্যায়ের অবসান ঘটতে যাচ্ছে।
ট্রুডো কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর পুত্র। পিয়েরে ট্রুডো ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে দেশটির রাজনীতিতে বেশ আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন।
২০১৫ সালে লিবারেল পার্টির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী হন তরুণ ট্রুডো। ক্ষমতায় এসে তিনি নতুন এক অগ্রগামী যুগের সূচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ট্রুডোর অর্জনের মধ্যে রয়েছে মন্ত্রিসভায় ৫০ শতাংশ নারী সদস্য রাখা, আদিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, জাতীয় কার্বন ট্যাক্স চালু, পরিবারের জন্য কর-মুক্ত শিশুভাতা প্রদান এবং বিনোদনের জন্য গাঁজা বৈধকরণ।
ফার্স্ট নেশন্স অ্যাসেম্বলির প্রধান সিন্ডি উডহাউস নেপিনাক ট্রুডোর পদত্যাগের পর আদিবাসী ইস্যুতে তার কাজের প্রশংসা করেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ট্রুডো ‘ফার্স্ট নেশন্সের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানে অর্থবহ পদক্ষেপ নিয়েছেন। যদিও অনেক কাজ বাকি আছে, তবে এ পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করেছে। ’
গত কয়েক বছরে ট্রুডোর সরকারের ওপর কালো মেঘ জমতে শুরু করে। তার সরকার একাধিক বিতর্ক এবং বেশ কয়েকটি স্বপ্রণোদিত কেলেঙ্কারির মুখে পড়ে। এর মধ্যে ছিল দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত একটি কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে বিতর্ক এবং প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর ‘ব্রাউনফেস মেকআপে’র ছবি প্রকাশ।
ব্রাউনফেস মেকআপ হল এক ধরনের মেকআপ, যা সাধারণত একজন শ্বেতাঙ্গ নিজের ত্বকের রঙকে বাদামী বা কালো করতে ব্যবহার করেন। এটি কখনো কখনো কোনো সংস্কৃতির প্রতি অসম্মানজনক বা বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশ করে। ব্রাউনফেস মেকআপ ঐতিহাসিকভাবে সাংস্কৃতিক বা জাতিগত হাস্যরসের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, যা বর্তমানে অনেক দেশে ব্যাপক সমালোচিত।
২০২২ সালের শুরুর দিকে কানাডার রাজধানী অটোয়া ট্রাকচালকদের অবরোধের মুখে অচল হয়ে পড়ে। টিকা না নেওয়া ট্রাক চালকরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর তাদের কোয়ারেন্টিনে থাকা বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। তারা এ বিক্ষোভের নাম দেন ‘ফ্রিডম কনভয়’। ট্রুডো সরকারের বিধিনিষেধের প্রতিবাদ জানাতে তারা জড়ো হন।
কানাডা করোনা মহামারি থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করলে আবাসন ও খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঘটে। ট্রুডোর সরকার উচ্চাভিলাষী অভিবাসন লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দেয়, কারণ সরকারি পরিষেবাগুলোতে চাপ বাড়তে শুরু করে।
২০২৪ সালের শেষ দিকে, ট্রুডোর জনপ্রিয়তা ছিল সবচেয়ে কম। একটি জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ২২% কানাডিয়ান মনে করেন যে তিনি ভালো কাজ করছেন।
অটোয়ায় একটি ছোট প্রতিবাদী দল পার্লামেন্ট হিলের বাইরে ট্রুডোর পদত্যাগ উদযাপন করে নাচছিল। তবে, এক পথচারী বলেন, তিনি মনে করেন ট্রুডোর সময়কালে পরিস্থিতি ভালো ছিল।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার বাসিন্দা হেমস গামারা বিবিসিকে বলেন, আমি একজন কাঠমিস্ত্রি। আমি নিজের কাজ করি। আমার মজুরি পাই, বিল পরিশোধ করি। সব ঠিকঠাকই চলছে।
ম্যারিস কাসিভি নামে আরেক কানাডিয়ান বলেন, মনে হচ্ছে একটি যুগের সমাপ্তি ঘটল। তার কোনো দুঃখ হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি উত্তর দেন, ‘না। এটাই ঠিকঠাক।
২০১৩ সালে এমন এক সময়ে ট্রুডো লিবারেল পার্টির দায়িত্ব নেন, যখন দলটি গভীর সংকটে নিমজ্জিত ছিল। তখন কানাডার হাউস অব কমন্সে তৃতীয় অবস্থানে নেমে গিয়েছিল লিবারেল পার্টি। সেখান থেকে দলকে টেনে তুলে ২০১৫ সালে ক্ষমতায় বসেন ট্রুডো।
এরপর থেকে টানা গত নয় বছর ধরে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন লিবারেল পার্টির এই নেতা। পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার জন্য আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমি যখন ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী হই তখন থেকেই কানাডার স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছি। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে মজবুত করার জন্য কাজ করেছি।
লিবারেল পার্টি নতুন একজন নেতা নির্বাচিত না করা পর্যন্ত তিনি নিজ পদে দায়িত্ব পালন করবেন। চলতি বছরের ২০ অক্টোবরের মধ্যে কানাডায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা যাচ্ছে। কিন্তু তার আগেই দলেন নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হলেন জাস্টিন ট্রুডো। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে কানাডায় বেশকিছু জনমত সমীক্ষা চালানো হয়েছে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, কয়েক বছর আগেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা ট্রুডো ক্রমেই ভোটারদের আস্থা হারাচ্ছেন। এর অর্থ হলো এবারো যদি তিনি লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে থাকেন, তাহলে দলটি আগামী নির্বাচনে হেরে যেতে পারে।
টরন্টো থেকে বিবিসির সংবাদদাতা জেসিকা মারফি বলছিলেন, কানাডায় রাজনৈতিক অস্থিরতা এমন একটা সময় দেখা দিল যখন দেশটি অর্থনৈতিক কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে চলেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে বসতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আর ট্রাম্প বলেই দিয়েছেন কানাডা যদি অনুপ্রবেশকারীদের পাশাপাশি বেআইনি মাদক আমেরিকায় প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, তাহলে কানাডা থেকে আসা পণ্যের ওপরে তিনি ২৫ শতাংশ কর আরোপ করবেন। এ পরিমাণ কর কানাডার অর্থনীতিকে শেষ করে দিতে পারে।
বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে কিছুদিন আগে পদত্যাগ করেন কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড। মূলত এ ঘটনার পর থেকেই ট্রুডোর ওপর পদত্যাগের চাপ বাড়তে থাকে।