পর্যটন নগরী কক্সবাজারের পেকুয়ার আলোচিত কলেজ শিক্ষককে অপহরণের পর হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী ও মূলহোতা,পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ওরফে গরু জাহাঙ্গীর অবশেষে গ্রেফতার হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১৫ এবং র্যাব-৭ এর যৌথ আভিযানিক দল।
জানা যায়,২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ইং বিকেলে কক্সবাজার জেলার পেকুয়া সেন্ট্রাল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আরিফ অপহরণের শিকার হন। স্বজনদের মতে, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ইং বিকেল ৫টার দিকে পারিবারিক প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আরিফ। এরপর আনুমানিক রাত সাড়ে নয়টার দিকে বাড়ি না ফেরায় তার স্ত্রী মেহবুবা আনোয়ার লাইজু তাকে ফোন দেন। কিন্তু ভিকটিম আরিফ এর মোবাইলে রিং হলেও কল রিসিভ হয়নি। পরিবারের লোকজন সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে তার স্ত্রী ঐ দিন রাত ১১.৫০ ঘটিকার দিকে পেকুয়া থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন, যার জিডি নং-১০৩৫, তাং ২৮/০৯/২০২৪।
বিশ্বস্ত সুত্রে প্রকাশ ঘটনার দিন বাদ এশা স্থানীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে অধ্যক্ষ আরিফের পরিবারের জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে শালিশের কথা ছিল। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে অধ্যক্ষ আরিফের মোবাইল নম্বর থেকে তার মায়ের মোবাইলে কল আসে। কল রিসিভ করলে অজ্ঞাত ব্যক্তি তাকে (আরিফের মা) জানান যে, তার ছেলে অপহরণের শিকার হয়েছে। পরবর্তীতে রাত ২টার দিকে পুনরায় কল করে চট্টগ্রাম নগরীর ফ্রিপোর্ট থেকে অধ্যক্ষ আরিফকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হলেও পরদিন ফ্রিপোর্ট এলাকায় গিয়ে অনেক খুঁজেও অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আরিফের খোঁজ পাওয়া যায়নি। অনেকবার চেষ্টা করলেও আরিফের মোবাইলে কল ঢুকেনি। পরে আরিফের মুক্তির জন্য ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে আরিফের স্ত্রীকে সেই টাকা নিয়ে পরদিন বিকেল ৪টার মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর নতুন ব্রিজ পুলিশ বক্সের সামনে যেতে বলেন অপহরণকারীরা। পাশাপাশি তারা হুমকি দিয়ে বলেন, কোন চালাকি অথবা পুলিশ, র্যাব কিংবা আর্মির দ্বারস্থ হলে তোর স্বামীর মরদেহ পাবি”। কিন্তু এরপর আবারও মোবাইল বন্ধ করে দেন তারা। এ ঘটনায় ভিকটিমের ছোট ভাই বাদী হয়ে কক্সবাজারের পেকুয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন, যার মামলা নং ০২, তাং ০১/১০/২০২৪, ধারা-৩৬৪/৩৪ পেনাল কোড ১৮৬০। এরই মধ্যে গত ১১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখ বিকেল অনুমান সাড়ে ৩টার দিকে অধ্যক্ষ আরিফের নিজ বাড়ীর পার্শ্ববর্তী পুকুর থেকে তার বস্তাবন্দী গলিত লাশ উদ্ধার হয়। অধ্যক্ষ আরিফকে অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি ও হত্যা করে বস্তাবন্দি লাশ পুকুরের পানির নিচে গুম করার খবর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হলে জনমনে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। আরিফ হত্যার বিচার ও আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের জোর দাবি তুলে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন নেটিজেন ও এলাকাবাসীরা।
ভিকটিম আরিফ অপহরণের পর থেকে ছায়াতদন্ত শুরু করে র্যাব-১৫। যার ধারাবাহিকতায় ১১ অক্টোবর,২০২৪ তারিখ সাড়ে ৩ঘটিকার সময় র্যাবের যৌথ আভিযানিক দল চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাধীন আন্দরকিল্লা কাঁচাবাজার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ঘটনার অন্যতম হোতা এবং অধ্যক্ষ আরিফের স্বজনদের নিকট সরাসরি মোবাইলে কল করে মোঃ রুবেল খান (২৭),
গ্রেফতারকৃত রুবেলের স্বীকারোক্তি মতে, অপহরণের পর এই নৃশংস হত্যাকান্ডে রুবেলসহ পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম জড়িত রয়েছে মর্মে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করে। তার দেওয়া তথ্য মোতাবেক উক্ত হত্যাকান্ডে জড়িত জাহাঙ্গীর আলম’কে গ্রেফতারে র্যাবের আভিযানিক কার্যক্রম চলমান রাখে। এবং তারই অংশ হিসেবে ঘটনার প্রধান পরিকল্পনাকারী ও মূলহোতা হিসেবে জাহাঙ্গীর আলম ওরফে গরু জাহাঙ্গীর’কে শনাক্ত ও বিস্তারিত পরিচয় এবং তার অবস্থান উদঘাটনে সমর্থ হয় র্যাব। অবশেষে ১২ অক্টোবর, ২০২৪, সাড়ে ৭ঘটিকার সময় র্যাব-১৫ এবং র্যাব-৭ এর একটি চৌকস যৌথ আভিযানিক দল র্যাব ফোর্সেস সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখার সার্বিক সহযোগিতায় চট্টগ্রাম মহানগরীর পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ওরফে গরু জাহাঙ্গীর (৫০), পিতা-রমিজ আহাম্মদ, সাং-মাদবরপাড়া, ৫নং ওয়ার্ড, পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, থানা-পেকুয়া, জেলা-কক্সবাজার’কে গ্রেফতারপূর্বক ০১টি ডাইরি, ০১টি স্মার্ট ফোন, ০১টি ওয়াইফাই রাউটার এবং নগদ ২২,২২০/- (বাইশ হাজার দুইশত বিশ) টাকা উদ্ধার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতারকৃত জাহাঙ্গীর আলম ওরফে গরু জাহাঙ্গীর হচ্ছে আলোচিত অধ্যক্ষ আরিফ অপহরণ ও হত্যাকান্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী ও মূলহোতা। আনুমানিক ৭/৮ বছর যাবত জাহাঙ্গীর ও অধ্যক্ষ আরিফের পরিবারের মধ্যে বিবাদ ও সম্পর্কের টানাপোড়েন চলে আসছিল। জাহাঙ্গীর ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় দীর্ঘদিন তার এই দখলদারত্ব চুপচাপ মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছিলেন অধ্যক্ষ আরিফ ও তার পরিবার। ৫ আগস্টের পর অধ্যক্ষ আরিফ নিজেদের জমি ফিরে পেতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে আইনগত লড়াই শুরু করেন। এ নিয়ে আরিফের উপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন জাহাঙ্গীর। এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার আরিফের সঙ্গে কথা কাটাকাটিও হয় তার। মূলত এরই জের ধরে আরিফকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন সে।
মুলত তারই পরিকল্পনায় অধ্যক্ষ আরিফকে অপহরণ,হত্যা,মুক্তিপণ চাওয়া পরবর্তীতে বস্তাবন্দি করে পুকুরের পানিতে মৃতদেহ গুম করারমত জঘন্যতম ঘটনা সংগঠিত হযেছে যেখানে রুবেল,জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজন সরাসরি জড়িত।
র্যাব-১৫ ও র্যাব-৭ এর আভিযানিক দলের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রথমে ১১ অক্টোবর ঘাতক রুবেল পরে ১২ অক্টোবর হত্যাকান্ডের মাস্টারমাইন্ড জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।